পলাশীর যুদ্ধ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ইংরেজরা বুঝিতে পারিলেন , যাবৎ এই দুর্দান্ত বালক বাঙ্গালার সিংহাসনে অধিরূঢ় থাকিবেক , তাবৎ কোন প্রকারে ভদ্রস্থতা নাই । অতএব , তাহারা কি উপায়ে নিরাপদ হইতে পারেন , মনে মনে এ বিষয়ের আন্দোলন করিতেছেন ,
এমন সময়ে দিল্লির সম্রাটের কোষাধ্যক্ষ পরাক্রান্ত শেঠবংশীয়েরা , নবাবের । সর্বাধিকারী রাজা রায়দুর্লভ , সৈন্যদিগের ধনাধ্যক্ষ ও সেনাপতি মীরজাফর এবং উমিচাদ ও যােজা রাজীদ নামক দুইজন ঐশ্বর্যশালী বণিক ইত্যাদি কতিপয় প্রধান ব্যক্তি তাহাদের নিকট এক পত্র প্রেরণ করিলেন । তাহারা , সিরাজদ্দৌল্লাকে রাজ্যভ্রষ্ট করিবার নিমিত্ত , প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া , ইঙ্গরেজদিগের নিকট সাহায্য প্রার্থনায় গােপনে পত্র প্রেরণ করেন । ইঙ্গরেজরা বিবেচনা করিলেন , আমরা সাহায্য না করিলেও এই রাজবিপ্লব ঘটিবেক ; সাহায্য করিলে , আমাদের অনেক উপকারের সম্ভাবনা আছে । কিন্তু তৎকালের কৌন্সিলের মেম্বাররা প্রায় সকলেই ভীরুস্বভাব ছিলেন ; এমন গুরুতর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতে তাহাদের সাহস হইল না । কিন্তু ক্লাইব অকুতােভয় ও অত্যন্ত সাহসী ছিলেন । তিনি উপস্থিত প্রস্তাবে সম্মত হইতে , কোনওক্রমে , পরখ হইলেন না । ক্লাইব , এপ্রিল - মে দুই মাস মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট ওয়াটস সাহেব দ্বারা , নবাবের প্রধান প্রধান কর্মচারীদিগের সহিত মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন । এইরূপে সমুদয় স্থিরীকৃত হইলে , ক্লাইব সিরাজদ্দৌল্লাকে এই মর্মে পত্র লিখিলেন যে , আপনি ইঙ্গরেজদিগের অনেক অনিষ্ট করিয়াছেন , সন্ধিপত্রের নিয়ম লঙ্ঘন করিয়াছেন , যে যে ক্ষতিপূরণ স্বীকার করিয়াছিলেন , তাহা করেন নাই এবং ইন্সরেজদিগকে বাঙ্গালা হইতে তাড়াইয়া দিবার নিমিত্ত , ফরাসীদিগকে আহ্বান করিয়াছেন । অতএব , আমি স্বয়ং মুর্শিদাবাদে যাইতেছি , আপনকার সভার প্রধান প্রধান লােকদিগের উপর ভর দিব , তঁাহাৱা সকল বিষয়ের মীমাংসা করিয়া দিবেন । নবাব , এই পত্রের লিখনভঙ্গি দেখিয়া এবং ক্লাইৰ স্বয়ং আসিতেছেন ইহা পাঠ করিয়া অতিশয় ব্যাকুল হইলেন এবং ইন্সরেজদিগের সহিত যুদ্ধ অপরিহরণীয় স্থির করিয়া , অবিলম্বে সৈন্য সংগ্রহপূর্বক , কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিলেন । ক্লাইবও , ১৭৫৭ খ্রীঃ অব্দের জুন মাসের আরম্ভেই , আপন সৈন্য লইয়া প্রস্থান আক্রমণ ও অধিকার করিলেন । করিলেন । তিনি ১৭ ই জুন কাটোয়াতে উপস্থিত হইলেন এবং পরদিন তথাকার দুর্গ । ১৯ - এ জুন , ঘােরতর বর্ষা আরম্ভ হইল । ক্লাহ , নদী পার হইয়া নবাবের সহিত যুদ্ধ করি , কি ফিরিয়া যাই , মনে মনে এই আন্দোলন করিতে লাগিলেন । পরিশেষে , অভিনিবেশপূর্বক বিবেচনা করিয়া ভাগ্যে যাহা থাকে ভাবিয়া , যুদ্ধপক্ষই অবলম্বন করিলেন । তিনি স্থির বুঝিয়াছিলেন , যদি এতদূর আসিয়া , এখন ফিরিয়া যাই , তাহা হইলে , বাঙ্গালাতে ইন্সরেজদিগের অভ্যুদয়ের আশা একেবারে উচ্ছিন্ন হইবেক । ২২ - এ জুন , সূর্যোদয় কালে , সৈন্যসকল গঙ্গা পার হইতে আরম্ভ করিল । তাহারা , অবিশ্রান্ত গমন করিয়া , রাত্রি দুই প্রহর একটার সময় , পলাশীর বাগানে
সাহায্য উপস্থিত হইল । প্রভাত হইবামাত্র , যুদ্ধ আরম্ভ হইল । ক্লাইব , উৎকণ্ঠিত চিত্তে , মীরজাফরের ও তদীয় সৈন্যের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন , কিন্তু তখন পর্যন্ত তাহার ও তদীয় সৈন্যের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না । যুদ্ধক্ষেত্রে নবাবের পঞ্চদশ সহস্র অশ্বারােহ ও পঞ্চত্রিংশৎ সহস্র পদাতিক সৈন্য উপস্থিত হইয়াছিল । কিন্তু তিনি স্বয়ং চাটুকারবর্গে বেষ্টিত হইয়া , সকলের পশ্চাদভাগে তাবুর মধ্যে ছিলেন । মীরমদন নামক এক সেনাপতি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন । মীরজাফর , আত্মসৈন্য সহিত , তথায় উপস্থিত ছিলেন , কিন্তু যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন নাই । বেলা প্রায় দুই প্রহরের সময় কামানের গােলা লাগিয়া , সেনাপতি মীরমদনের দুই পা উড়িয়া গেল । তিনি তৎক্ষণাৎ নবাবের তাবুতে নীত হইলেন এবং তাহার সম্মুখেই প্রাণত্যাগ করিলেন । তখন , নবাব মীরজাফরকে ডাকাইয়া আনিলেন , এবং তাহার চরণে স্বীয় উষ্ণীষ স্থাপিত করিয়া , অতিশয় দীনতা প্রদর্শনপূর্বক , এই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন যে , অন্ততঃ আমার মাতামহের অনুরােধে , আমার অপরাধ ক্ষমা করিয়া , এই বিষম বিপদের সময় সহায়তা কর । জাফর অঙ্গীকার করিলেন , আমি আত্মধর্ম প্রতিপালন করিব , এবং তাহার প্রমাণ স্বরূপ , নবাবকে পরামর্শ দিলেন , অদ্য বেলা অধিক হইয়াছে , সৈন্যসকল ফিরাইয়া আনুন । যদি জগদীশ্বর কৃপা করেন , কলা আমরা সমুদয় সৈন্য একত্র করিয়া , যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইব । তদনুসারে নবাব সেনাপতিদিগকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইবার আজ্ঞা পাঠাইলেন । নবাবের অপর সেনাপতি মােহনলাল ইঙ্গরেজদিগের সহিত ঘােরতর যুদ্ধ করিতেছিলেন ; কিন্তু নবাবের এই আজ্ঞা পাইয়া নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্বক নিবৃত্ত হইলেন । তিনি অকস্মাৎ ক্ষান্ত হওয়াতে , সৈন্যদিগের উৎসাহ ভঙ্গ হইল । তাহারা , ভঙ্গ দিয়া , চারিদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল । সুতরাং , অনায়াসে ক্লাইবের সম্পূর্ণ জয়লাভ হইল ।। তদনন্তর , সিরাজদ্দৌল্লা , এক উষ্ট্রে আরােহণ করিয়া , দুই সহস্র অশ্বারােহ । সমভিব্যাহারে , সমস্ত রাত্রি গমনকরতঃ , পরদিন বেলা ৮ টার সময় , মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হইলেন এবং উপস্থিত হইয়াই আপনার প্রধান প্রধান ভৃত্য ও অমাত্যবর্গকে সন্নিধানে আসিতে আজ্ঞা করিলেন । কিন্তু তাহারা সকলেই স্ব স্ব আলয়ে প্রস্থান করিল । অন্যের কথা দূরে থাকুক , সে সময়ে , তাহার শ্বশুর পর্যন্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন । নবাব , সমস্ত দিন একাকী আপন প্রাসাদে কালযাপন করিলেন । পরিশেষে , নিতান্ত হতাশ হইয়া , রাত্রি তিনটার সময়ে মহিষীগণ ও কতিপয় প্রিয়পাত্র সমভিব্যাহারে করিয়া , শকটারােহণপূর্বক , ভগবানগােলায় পলায়ন করিলেন । -যুদ্ধ সমাপ্তির পর , মীরজাফর , ক্লাইবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া , তাহার রণজয় নিমিত্ত সভাজনও হর্ষ প্রদর্শন করিলেন । অনন্তর , উভয়ে একত্র হইয়া মুর্শিদাবাদে সাহিত্য চলিলেন । তথায় উপস্থিত হইয়া , মীরজাফর রাজকীয় প্রাসাদ অধিকার রিলেন । রাজধানীর প্রধান প্রধান লােক এবং প্রধান প্রধান রাজকীয় কর্মচারী সমবেত হইলেন । অবিলম্বে এক দরবার হইল । ক্লাইব , আসন হইতে গাত্রোখান করিয়া , মীরজাফরের কর গ্রহণপূর্বক সিংহাসনে বসাইয়া তাহাকে বাঙ্গালা , বিহার , উড়িষ্যার নবাব বলিয়া সম্ভাষণ ও বন্দনা করিলেন । এদিকে , সিরাজদ্দৌলা , ভগবানগােলা হইতে রাজমহলে পৌঁছিয়া , আপন স্ত্রী ও কন্যার জন্য পাক করিবার নিমিত্ত , এক ফকিরের কুটিরে উপস্থিত হইলেন । পূর্বে ঐ ফকিরের উপর তিনি অনেক অত্যাচার করিয়াছিলেন । এক্ষণে ঐ ব্যক্তি তাহার অনুসন্ধানকারীদিগকে তৎক্ষণাৎ তাহার পঁহুছ সংবাদ দিলে , তাহারা আসিয়া তাহাকে রুদ্ধ করিল । নবাব অতি দীন বাক্যে , তাহাদের নিকট বিনয় করিতে লাগিলেন । কিন্তু তাহারা , তদীয় বিনয়বাক্য শ্রবণে বধির হইয়া , তাহার সমস্ত স্বর্ণ ও রত্ন লুটিয়া লইল , এবং তাহাকে মুর্শিদাবাদে প্রত্যানয়ন করিল । যকালে তিনি রাজধানীতে আনীত হইলেন , তখন মীরজাফর , অধিক মাত্রায় অহিফেন সেবন করিয়া , তন্দ্রাবশে ছিলেন ; তাহার পুত্র পাপাত্মা মীরণ , সিরাজদ্দৌলার উপস্থিতি সংবাদ শুনিয়া তাহাকে আপন আলয়ের সন্নিধানে রুদ্ধ করিতে আজ্ঞা দিল ।... মহম্মদী বেগ নামক এক ব্যক্তি আলিবর্দি খার নিকট প্রতিপালিত হইয়াছিল ; পরিশেষে সেই দুরাত্মাই এই নিষ্ঠুর ব্যাপারের সমাধানের ভার গ্রহণ করিল । দুরাচার মহম্মদী বেগ তরবারি প্রহার দ্বারা তাহার মস্তক ছেদন করিল । ( সংক্ষেপিত )